“রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি”:পঁচিশের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক একুশ স্মরণ

কলকাতা , ২১ ফেব্রুয়ারি : কবিন্দ্র রবীন্দ্র বাঙালির বৃটিশ ঘেষা মিনমিনে স্বভাবকে কটাক্ষ করে তাঁর ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার র শেষ দুই পঙ্‌ক্তিতে লিখেছিলেন  –

সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,

রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।’

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি , আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবসে দাঁড়িয়ে গুরুকবির সেই অনুভবের কি মারাত্মক প্রাসঙ্গিকতা ! মাতৃ ভাষা দিবস – ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি    আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের হরতাল।সরকার থেকে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা ।

পাকিস্তান সরকারের ১৪৪ ধারার পরোয়া না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকেন কলা ভবনের সামনে। প্রথমে পুলিশ বাধা দেয়নি। বাড়তে থাকে সমাবেশ। ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা দশ হাজার অতিক্রম করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের  পক্ষ থেকে  ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বক্তৃতা দেওয়া হয় । স্লোগান ওঠে ১৪৪ ধারা মানি না, মানব না।সকাল ১১ টা নাগাদ ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা রাস্তায় মিছিলে নামতে গেলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। কয়েক জনকে ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছাত্রদের গ্রেফতারের পরই ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। ছাত্ররা প্রথমে আইন পরিষদের সদস্যদের আইনসভায় যোগ দিতে বাধা দিলেও পরে সিদ্ধান্ত নেন আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি জানাবেন।এরপর  ছাত্ররা আইনসভার দিকে এগোতে গেলে পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালায়। নিহত হন অসংখ্য আন্দোলনকারী।

এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর সমাজের  শুভবুদ্ধিসমম্পন্ন সাংস্কৃতিক জগতের মানুষজন এগিয়ে আসেন।এর ফলে  ভাষা আন্দোলন আরও গতি পায়। এরপর ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলে ৯ মে গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।এরপর  ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়।

কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে  ইতিহাস মেনে খাতায় কলমে ঘটা করে একদিন মাতৃভাষা দিবস পালন করার আড়ালে বাস্তব চিত্র কি ?  সমগ্র পৃথিবী জুড়েই সর্বক্ষেত্রে   রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক সুবিধা কায়েমের লক্ষ্যে কর্তৃত্ব আর আধিপত্য তো চলবেই।কিন্তু মাতৃভাষা তো মাতৃদুগ্ধের সমান। মাতৃ ভাষার বিরুদ্ধে এই মাৎস্যন্যায়কে রুখে দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা হবে না ! পরিকল্পনা , কৌশল ইত্যাদি  থাকবে না !  আমরা কে কবে ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান,  সঙ্ঘ, রাষ্ট্র সাপেক্ষে  এ নিয়ে ভেবেছি ? বরং বাস্তবে দেখেছি বিপ্রতীপ করুন  চিত্র ! বাঙালি লেখকেরা বাংলায় লেখেন না। জমায়েতে ,আড্ডায় বাংলা বলেন না, লজ্জা , হীনমন্যতা বোধ করেন।বাংলা সিনেমা দেখা সময় ও অর্থ নষ্ট বলে মনে করেন , বাঙালিরা বাংলা বই পড়তে প্রবল অনীহা অরুচি  প্রকাশ করেন। স্বচ্ছন্দ্ আদৌ নন , তবুও পরভাষায় পান্ডিত্যের বৃথা আস্ফালন প্রদর্শন করেন। এই তো চারিদিকের করুন হতাশজনক চিত্র !

ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে একটা জাতি কেমন অনায়াসে ,অবলীলায় নিজের ভাষা-হত্যা দেখছে এবং এই অপঘাতে কিভাবে মনের আনন্দে অকাতরে যোগ দিচ্ছে  প্রচ্ছন্ন শুস্ক অহমিকায় ! এ যেন  নৃশংস বীভৎস  আমোদ ! প্রশাসনিক -রাজনৈতিক বোদ্ধারা  কত যুক্তি ঘটে করে  দিয়ে প্রাইমারি থেকে ইংরেজি তুলে দিলেন।কিন্তু  বাংলাকে  ‘কাজের ভাষা’  করলেন না।সব কাগুজে ,রাজনৈতিক  স্বার্থকেন্দ্রিক লোকভোলানো প্রয়াস আর কি ! রুটি-রুজিতে বাংলা নেই কোথাও ! বাংলা ভাষা  সেই দুয়োরানিই রয়ে  গেল । যত দিন গেল, বাংলা কোণঠাসা হতে লাগল। ওয়াজেদ আলির ভাষায় “সেই ট্রেডিশন সমানে চলছে”  

অনেকেই আমরা আশায় বুক বাঁধি  ‘গ্রাম বাংলা হয়তো বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে দেবে । বলা বাহুল্য সেখানেও হতাশার আশা বৈকি ! সে পথেও যে  ইংরেজি-হিন্দি র  দাপট স্পষ্ট প্রতীয়মান ।গ্রামের বিদ্যালয়ে যে ছেলেটা চমৎকার বাংলা লিখতে পারে , বাংলা বই পড়তে ভালোবাসে , কাঁচা হাতে বাংলায় কবিতা লেখা যার অকৃত্রিম শখ  — তার কোনও কদরই  নেই।কেউ পিঠ চাপড়ে উৎসাহ দেওয়ার নেই।বরং তাকে থাকতে হয় পাশ্চাত্য ভাষার অহমিকার আগুনে কুঁকড়ে ,লুকিয়ে। এ যেন  সুকুমার রায়ের ‘নন্দলালের মন্দ কপাল’ . বেচারা জানেই  না বাংলায় নাক সিটকানো আর অবজ্ঞা ছাড়া কোনও প্রাইজ় নেই ! সব প্রাইজ় অন্যত্র ! তখন কি মনে সায় দেয় না   ‘কান্ট রিড বাংলা’-র দলে ভিড়ে যেতে ! আর  যদি কঠোর বাস্তবের রূঢ় আঘাত হেতু  এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য   তথাকথিত  ‘মাতৃভাষা দিবস’  একুশ কেই  ‘বিমাতৃভাষা  দিবস’ রূপে বেছে  নেওয়া হয়  খুব অপরাধ হবে কি !

আজ  একথা বাস্তব সত্য যে বাংলাভাষীরাই আজ ভাষা থেকে পালানোর পথ খুঁজছেন ! সর্বত্রই বানান ভুল, বাক্য ভুল ,বাক্য-বানান-শব্দে অপার  ভ্রান্তিবিলাস ! জনপরিসরে বাংলা ভাষা নিয়ে অসীম  কুণ্ঠা, সংশয়, লজ্জা,অপমান, অনীহা আর অবহেলা  ।তাই একুশে ফেব্রুয়ারির ‘বাংলা’ ও  ‘বাঙালি’র  উন্মাদনা সে জন্য যথেষ্ট মানসিক পীড়া দেয় বৈকি !অস্বীকার করার উপায় নেই  সারা বছর আমরা বাংলা ভাষা,  সংস্কৃতি, সাহিত্য নিয়ে উদাসীন, অসার , ভাবলেশহীন থাকি আর হঠাৎ উদযাপনের  হুল্লোড়ে  একদিন  সক্রিয় হয়ে উঠি।এ যেন শাস্ত্রীয় কোন বাৎসরিক পূজা পার্বন , ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ! হায়  রে উদযাপন প্রিয়  দিবস কালচারে মেতে  ওঠা বাঙালি ! কবে ফিরবে মোদের চেতনা ! কবে আমরা পরম তৃপ্তিতে  পান করব মাতৃস্তন্যসুধা রূপে মাতৃভাষাকে !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *