অজানার আলোকে মনোজ ‘বাঞ্ছারাম’ মিত্র : ফিরে  দেখা

যুগবীক্ষণ ডিজিটাল ডেস্ক (tistamondal4tista@gmail.com)

অবশেষে  বড় সাধের প্রাণাধিক প্রিয়  নিজের  ‘বাগান’ ছেড়ে  চিরবিদায় নিলেন মনোজ  ‘বাঞ্ছারাম’ মিত্র ।বাংলা  ছায়াছবির এই জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা , কিংবদন্তি  নাট্যকার আজ সকাল ৮ টা  ৩০ এর কাছাকাছি সময়ে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন ।  বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। গত  সেপ্টেম্বর মাসেই সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু এবারে আর ফেরা হলো না।কার্ডিয়াক মায়োপিয়া ,ডায়াবিটিস সহ বিভিন্ন রোগে দীর্ঘদিন ভুগছিলেন তিনি।এবারে নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি  । তাঁর হৃদযন্ত্রও ঠিকঠাক কাজ করছিল না। এবারে আর শেষ রক্ষা হলো না । সেই সঙ্গে দাঁড়ি টানতে হল উত্থান, পতনে ভরা জীবনের অভিনয় মঞ্চ থেকে । জীবনের বাগানে বাঞ্ছারাম রেখে গেলেন স্ত্রী আরতি মিত্র  , কন্যা  ময়ূরী  এবং অগণিত গুণমুগ্ধ  দর্শক-ভক্ত কুলকে   ।

      ১৯৩৮ সালে ২২ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলাদেশের খুলনা জেলার সাতক্ষীরার ধুলিহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবার নাম অশোক কুমার মিত্র এবং মা রাধারানী মিত্র।মনোজের সম্পূর্ণ নাম ছিল মনোজ কুমার মিত্র এবং ডাকনাম বুদ্ধদেব । মনোজরা ৫ ভাইবোন , ৩ ভাই এবং ২ বোন।সাহিত্যিক অমর  মিত্র  তাদের মধ্যে অন্যতম।   কলকাতার উল্লেখযোগ্য কলেজ গুলির মধ্যে অন্যতম একটি স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। স্নাতক স্তর পাশ করেন তিনি।মূলত থিয়েটারের প্রতি মনোনিবেশ ঘটে, এই কলেজের মাধ্যমেই। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম এ সম্পূর্ণ করে গবেষণার কাজে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। এরপর সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে দর্শনে অধ্যাপনা শুরু করার।  কিছুদিন পরেই তিনি যোগদান করেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগে।

      ১৯৫৭ সালে কলকাতায় মঞ্চনাট্যের মাধ্যমে শুরু করেন অভিনয়ের পথ চলা , এরপর ১৯৭৯ সালে তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় যাত্রা শুরু করেন, প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৯৭২ সালে তাঁর রচিত নাটক ‘চাক ভাঙ্গা মধুর’ মাধ্যমে তার পরিচিতি ঘটতে শুরু করে। তপন সিনহা পরিচালিত ছবি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করেন মিত্র। বাংলা ছায়াছবির উল্লেখযোগ্য পরিচালক মিত্র তপন সিনহা, সত্যজিৎ রায় , বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ,বাসু চ্যাটার্জী, শক্তি সামন্ত, গৌতম ঘোষ ,তরুণ মজুমদারদের মতন পরিচালকদের  ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে বলাবাহুল্য সত্যজিৎ রায়ের মতন অন্যতম পরিচালক রচিত ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘গণশত্রু’ ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গেছে মনোজকে। বহু বাংলা ছায়াছবিতে কমিক চরিত্র  সহ নেতিবাচক চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি।

           শুধুমাত্র অভিনয়ই নয় অভিনয়ের পাশাপাশি নাটকেও যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে তাঁর , বলাবাহুল্য একাধারে অভিনেতা এবং অন্যদিকে নাট্যকার হিসেবে নাটক লেখা থেকে শুরু করে পরিচালনা এবং তাতে অভিনয়ও করতেন তিনি । মন্মথ রায় ছিলেন  তাঁর নাট্যগুরু ।মিত্র প্রতিষ্ঠিত নাট্যগোষ্ঠীও ছিল একটি ।  সেটির নাম ‘সুন্দরম’ ।পরবর্তীতে ‘ঋতায়ন’ নামক এক নাট্যদল তৈরি করলেও কিছুদিনের মধ্যে ‘সুন্দরম’ এ ফিরে আসেন তিনি। তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য কিছু নাট্য সৃষ্টি হল ‘বোগল ধিমান’  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এটি তার প্রথম নাটক এই নাট্যসৃষ্টির মাধ্যমে রাজ্যব্যাপী প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি।  মিত্রের সৃষ্টি অন্যতম নাটক গুলি হল ‘সাজানো বাগান’ ,  ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘কালবিহঙ্গ’ , ‘পরবাস’, ‘অলকানন্দর পুত্র কন্যা’, ‘রাজবিহঙ্গ’ , ‘জা নে ভারতে’, ‘দেউড়ি’ সহ প্রভৃতি নাটকগুলি রচনা করেছিলেন তিনি। এছাড়াও চলচ্চিত্র এবং থিয়েটারের উপর বেশ কিছু বই লিখেছেন তিনি।  মিত্রের সুবিন্যস্ত এই অভিনয় ও নাট্যজীবন এর ঝুলিতে রয়েছে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু পুরস্কার  এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, ১৯৮৬ তে সেরা নাট্যকারের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার , ১৯৮৩ এবং ১৯৮৯ সালে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের জন্য পশ্চিমবঙ্গ  রাজ্য সরকার পুরস্কার , ১৯৮০ তে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার, ২০০৫ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির স্বর্ণপদক,  ২০১১ তে জন্মস্থান বাংলাদেশ মুনীর চৌধুরী পুরস্কার । ২০১২ সালে দীনবন্ধু পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে । সম্মানিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্গবিভূষণ সম্মানেও ।

ছোটবেলা থেকেই   গল্প লিখতেন মনোজ । একসময় ইচ্ছে ছিল গল্পকার হওয়ার।স্কুলের দেওয়াল পত্রিকা থেকে লেখালেখি শুরু।গল্প লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, নাটক করেছেন, সিনেমা করেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি রয়েছে, তার ওপর শিক্ষকতাও করেছেন– এভাবেই ছিল তাঁর  জমজমাট ব্যাপ্ত জীবন।শেষের দিকে অভিনয়ে প্রায় দেখা যেত না বললেই চলে কিন্তু লেখালেখি বন্ধ  হয় নি জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও। জীবদ্দশায় তিনি একান্ত ভাবেই চেয়েছিলেন মৃত্যুর পর তাঁর চোখের আলোয় অন্যের অন্ধকার দূর করতে। তাই তিনি মরণোত্তর চক্ষুদান করে গেছেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে।

মনোজ মিত্রকে ,বলা বাহুল্য,বাংলা সিনেমায় এক দুরন্ত  অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল তপন সিংহের ছবি ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ । মনোজেরই লেখা নাটক ‘সাজানো বাগান’ থেকে তৈরি হয়  ছবিটি । অশীতিপর বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম এর প্রাণের চাইতেও প্রিয় সেই বাগান। সেই বাগান আঁকড়ে ধরেই বৃদ্ধ বেঁচে  থাকার অনুপ্রেরণা পায়।এই নিয়েই বিভিন্ন সিরিয়াস ও মজার ঘটনা নিয়ে ছবিটি বাংলা চলচ্ছিত্রের অন্যতম সম্পদ বৈকি ।এক্ষত্রে উল্লেখযোগ্য অ্যাকাডেমি, মধুসূদন মঞ্চে মনোজ মিত্র  বাঞ্ছারামের চরিত্রে যে দুর্দান্ত জীবন্ত অভিনয়ের নজির রেখেছিলেন, চলচিত্রের ক্ষেত্রে তপন সিংহের ক্যামেরার সামনেও একইরকম সমান উদ্দীপনা উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তিনি । তাঁর অভিনয় জীবনের এক মাইলস্টোন এই ‘বাঞ্ছারাম’।

কিন্তু অনেকেরই অজানা যে এই বাঞ্ছারাম কিন্তু কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়।  মনোজের কোথায় সেরকমটাই জানা যায়। এই বাঞ্ছারাম কিন্তু তাঁর দেখা একজন জলজ্যান্ত মানুষ !’ অবিভক্ত বাংলাদেশে  কিশোর বয়সে তিনি তার দেখা পান পিসিমার সাথে এক পানের বরজে গিয়ে  । বুড়ো মানুষ, চুল ,দাড়ি সবই সাদা।  ভূতুড়ে মার্কা চেহারা।বাস্তবের সেই বৃদ্ধ বাঞ্ছা হাঁটেন কুঁজো হয়ে।খালি গা , পরনে  নোংরা খাটো ধুতি। সেই বাঞ্ছরামের সঙ্গে, চোখ ভরে মনোজ দেখছিলেন তাঁর বাগানের বহর।  প্রতিদিন  পানের বরজ থেকে বিনা পয়সায় এক গোছ করে পান আসত তাঁর  পিসির জন্য।  কিন্তু, গ্রামের অন্য কাউকে বাঞ্ছা  বাগানের ধারে কাছে ঘেঁষতেও দিতেন না। ওই পুরো বাগানটাই ছিল তাঁর একার সম্পত্তি।  সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মনোজ মিত্র  লেখা শুরু করেন  ‘সাজানো বাগান’। আর তখনই মনের গভীরে গেঁথে থাকা সেই শৈশবে দেখা  বাঞ্ছারাম বেরিয়ে আসে তাঁর কলমের মাধ্যমে । বলা যায় মনোজ রচিত নাটক ‘সাজানো বাগান’  সেই বৃদ্ধ মালিক মালির প্রতি  শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ।

বিজ্ঞান বলে এই পৃথিবীতে শুন্যস্থান বলে কিছু হয় না।  কিন্তু বাস্তব কিছু ক্ষেত্রে অন্য কথা বলে বৈকি ! বাংলা চলচ্চিত্র , থিয়েটার ও  নাট্য জগতে মনোজ মিত্র শুন্য স্থান কি পূরণ হওয়ার মতো ? 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *