যুগবীক্ষণ নিউজ ব্যুরো (Dial- 7604097600 ; Whatsap – 7365021506 )
কলকাতা , ১৫ ফেব্রুয়ারী:বাংলা সুর-সংগীতের আকাশে আবারও নক্ষত্রপতন। চলে গেলেন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় ।মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন বর্ষীয়ান এই শিল্পী।শনিবার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বিশেষ সূত্রে খবর , এই প্রবীণ শিল্পী অন্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন । গত সোমবার রাতে তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় ICU-তে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল তাঁকে। অবশেষে শনিবার সকাল ১০ টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রবীন্দ্র সদনে গান স্যালুটে শেষ বিদায় প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে ৷ রবীন্দ্র সদন থেকে শিল্পীর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে । শিল্পীর দেহ দান করা রয়েছে সেখানেই ৷প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলার সঙ্গীত মহল সহ গোটা সাংস্কৃতিক জগৎ ।তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে রবীন্দ্র সদনে হাজির ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক তথা অভিনেত্রী সুদেষ্ণা রায়, গৌতম ঘোষ, অরূপ বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেন ও দেবাশিস কুমার-সহ শিল্পীর গুণগ্রাহী অগণিত মানুষও ।মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় শিল্পীর এই মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য গত বুধবার মমতা হাসপাতালে গিয়ে শিল্পীকে দেখেও আসেন।শিল্পীর প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন– “কয়েকদিন আগেই হাসপাতালে গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম। প্রতুলদার মৃত্যু বাংলা গানের জগতে অপূরণীয় ক্ষতি। যতদিন বাংলা গান থাকবে, ‘আমি বাংলায় গান গাই’ মুখে মুখে ফিরবে।…” প্রসঙ্গত ‘বঙ্গবিভূষণ’, ‘সঙ্গীত মহাসম্মান’, ‘নজরুল স্মৃতি পুরস্কারে’ সম্মানিত করার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
সংগীতে এক সহজাত প্রতিভার নাম প্রতুল
প্রতুলের জন্ম ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার বরিশালে।বাবা প্রভাতচন্দ্র পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা বাণী মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ।প্রতুল ও তাঁর পরিবার দেশভাগের পর চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। স্কুলে পড়াকালীনই সংগীতে তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় মেলে । মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে সকলকে চমকে দেন তিনি । নিজে গানও লিখতেন।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রথাগত কোনও সঙ্গীতশিক্ষা তাঁর ছিল না । সংগীতে তাঁর ছিল অভূতপূর্ব সহজাত প্রতিভা। গানই ছিল তাঁর প্যাশন , অনুপ্রেরণা। নিজের হৃদয় থেকে নিঃসৃত আবেগকেই সুর ও কথার অপূর্ব মেলবন্ধনে বেঁধে ফেলতে পারতেন তিনি ।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও গান
প্রতুল আজীবন নিজের হৃদয়ে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন গানের অমলিন শিখা ।তাঁর গাওয়া ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটিই তাকে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসে এবং প্রতিষ্ঠা দেয় । হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তিনি চিকিৎসকদের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ শোনাতেন । তবে এই একটিই গান নয়, সৃষ্টি করেছেন একের পর এক গান। সারা জীবন ধরে অসংখ্য গানের মণিমুক্তো সৃষ্টি করে গিয়েছেন তিনি । বাংলা আধুনিক গান,হিন্দি ছবির গান এমনকি জাপানি গান থেকেও উপাদান সংগ্রহ করেছেন তিনি ।
প্রতুল সংগীত : তোমার কি কোনও তুলনা হয় !
প্রতুলের জীবনের প্রথম অ্যালবাম ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে ।যদিও এটি একক অ্যালবাম নয়, অন্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজ। প্রতুলের প্রথম একক অ্যালবাম ‘যেতে হবে’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে।প্রতুলের অপ্রকাশিত গানগুলি নিয়ে শেষ অ্যালবাম ‘ভোর’ প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে । তাঁর জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়াও রয়েছে ‘ছোকরা চাঁদ’, ‘আলু বেচো’, ‘সেই মেয়েটি’, ‘তোমার কি কোনও তুলনা হয়’, ‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ’-এর মতো গানও।এই গানগুলি গভীরভাবে শ্রোতার মন কেড়েছে বলা বাহুল্য । এ ছাড়া, সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে তৈরি ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ ছবির নেপথ্য শিল্পী ছিলেন তিনি।
সংগীত জীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’
এই পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি কখনও স্রষ্টাকেও ছাপিয়ে যায় , স্রষ্টা ও সৃষ্টি ওতপ্রোত ভাবে মিশে যায়। প্রতুলের জীবনের ‘ম্যাগনাম ওপাস’ হল ‘ আমি বাংলায় গান গাই’ এই গানটি । বাংলা ও বাঙালির আত্মা যেন এই গানের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার। এই গানটি গাওয়ার সময় তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত জাদু শ্রোতাদের মগ্ন করে রাখত । যতদিন এই পৃথিবীতে বাঙালি শ্রোতা থাকবে শৈল্পিক গরিমায় বেজে চলবে গানটি। রয়ে যাবে সেই গানের অমোঘ অনুরণন।
পাখি তো গান গায়, পাখির কী কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট লাগে?
নিজের গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার কখনওই পছন্দ করতেন না । প্রতুলদার একটা অদ্ভুত নীতি ছিল। প্রতুলদা কোনও মিউজিক্যাল যন্ত্রপাতি ছাড়াই গান গাইতেন। প্রতুলদাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায়, প্রতুলদা জানিয়ে ছিলেন, পাখি তো গান গায়, পাখির কী কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট লাগে? কোনও মিউজিশিয়ন লাগে! এটাই ছিল প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর সংগীত দর্শন।
বাংলার শিল্পী , বাঙালির শিল্পী
প্রকৃত শিল্পীরা মৃত্যুঞ্জয়ী।তারা বেঁচে থাকেন তাদের অমলিন শৈল্পিক সৃষ্টির মাধ্যমে। বাংলার প্রকৃতি,মাটি,জল,হাওয়া থেকে উঠে আসা একজন আদ্যন্ত খাঁটি মানুষ ছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।তাঁর কণ্ঠ আর শোনা যাবে না। তিনি আর বাংলায় গান গাইবেন না। তবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন বৈকি — বাংলার বুকে ,বাঙালির কাছে, বাংলা গানের কাছে।