যুগবীক্ষণ ডিজিটাল ডেস্ক(tista4tista@gmail.com) : আপামর জনগণের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন দয়ার সাগর নামে , হ্যাঁ, তিনিই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। কুসংস্কার কে পিছনে ফেলে রেখে অন্ধকার থেকে নারীদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসতে যার অবদান কখনোই ভোলার নয়। নারী শিক্ষার প্রচলন এবং তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি একাধারে তিনি ছিলেন একজন সমাজ – সংস্কারক , বিশিষ্ট বাঙালি পন্ডিত , গদ্যকার। তার অসামান্য পাণ্ডিত্যের উদাহরণ হল “বর্ণপরিচয়” একটি শিশু জন্মাবার পরে থেকেই তার অক্ষরজ্ঞান বা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তিনি এই অসামান্য অক্ষরলিপি তৈরি করেন। এছাড়াও বহু পাঠ্যপুস্তক, সংস্কৃত ব্যাকরণ, গ্রন্থ প্রভৃতি রচনা করেন বিদ্যাসাগর। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উপর অসামান্য শিক্ষাগত দক্ষতার জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন তিনি।

নব শিক্ষার যুগান্তরকারী ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে হুগলির বীর সিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা হলেন ভগবতী দেবী। প্রথম জীবনে তিনি গ্রামের সনাতন বিশ্বাসের পাঠশালায় ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে পাশের গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় নামক এক যুবক বীরসিংহ গ্রামে একটি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করেন সেখানে। পুনরায় বিদ্যাসাগর বৃক্ষ গ্রহণের জন্য সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন শিক্ষা গ্রহণের সময় শিক্ষাগুরু কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ঈশ্বরের চোখে আদর্শ হয়ে ওঠে। এরপর ১৮২৮ সালে তিনি তার পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর সঙ্গে কলকাতা চলে আসেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ১৮২৯ সালের পয়লা জুন কলকাতার গভর্মেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে খ্যাত) ব্যাকরণের তৃতীয় বিভাগে ভর্তি হন। সেই সময় সহপাঠী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কাকে। ১৮৩০ সালে একই কলেজে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ১৮৪১ সালে স্নাতক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করে মাত্র ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান পন্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হন।
নারী শিক্ষা বিস্তারের এবং নবসমাজ উদঘাটনের পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি। এই যুগান্তকারী সৃষ্টিতে বিদ্যাসাগরের অসীম অবদান। সেই সময় সমাজে নারী জাতির অবস্থান দেখে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই দেশের সর্বপ্রথম নারী জাতির উন্নতির প্রয়োজন। কারণ নারীদের মধ্যে যদি প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানো না যায় তাহলে কখনোই সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না। কারণ একটি শিশুর জন্মের পর সে প্রথম শিক্ষাটি অর্জন করে ঘরে থেকে তথা, মায়ের কাছে থেকেই। এছাড়াও মেয়েদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ না করা গেলে তারা যে কখনোই সমাজে যথা উপযুক্ত অবস্থান পাবেনা সেই দিকটি আঁচ করেছিলেন তিনি। নারী জাতির উন্নতির কথা মাথায় রেখেই বিদ্যাসাগর ও ড্রিংক ওয়াটার বিটন সচেষ্ট হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বলাবাহুল্য ভারতের প্রথম স্বদেশীয় বালিকা বিদ্যালয় ছিল এটি ( বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত)। সেই সময় বিদ্যালয়ের সম্পাদক হিসেবে ছিলেন বিদ্যাসাগর নিজেই । সর্বস্তরের নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যে জ্ঞানাক্ষর অর্জনেও তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। বিদ্যাসাগর নিজো উদ্যোগে ১৮৫৮ সালে নদীয়া ,বর্ধমান ,হুগলি ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই সময় প্রায় ১৩০০ মেয়েরা এই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। বলাবাহুল্য ১৮৬৪ সালে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয় এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টি। পরবর্তীতে কলকাতায় তিনি ১৮৭২ সালে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (বর্তমান নাম বিদ্যাসাগর কলেজ ) এবং মায়ের স্মরণে নিজগ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
সমাজ সংস্কারক হিসেবে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ । সংস্কৃতের দক্ষ পন্ডিত হওয়ার সত্বেও পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি গ্রহণে দ্বিমত করেননি তিনি। সমাজে এক যুগান্তকারী প্রথা সৃষ্টি করেন তিনি। সমাজে কুসংস্কার গ্রস্থ ,অবহেলিত, অসহায়, অত্যাচারিত, অবলা বিধবা নারীদেরকে সমাজের এই শোষণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তিদানের জন্য তিনি বিধবা বিবাহ প্রহার প্রচলন ঘটান, এবং ১৮৫৬ সালে সরকার বিধবা বিবাহ কে আইনত সম্মতি প্রদান করেন। এই প্রথার প্রচলন ঘটিয়েই তিনি শুধু ক্ষান্ত থাকেননি । সমাজের মধ্যে ধর্মের নামে চলতে থাকা কুসংস্কার, বর্বরতা ,অশৃংঙ্খল চিন্তাধারার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। এই প্রথার প্রণয়নের উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক বিধবা মহিলাকে নতুন করে আবার সামাজিক জীবনের পথে চালিত করার পথ তৈরি করে দিয়ে ছিলেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তার পুত্র নারায়ণ চন্দ্র এক অসহায় বিধবাকে বিবাহ করেন। নারী জাতির অগ্রগতি দেখতে চেয়েছিলেন তিনি, দেখতে চেয়েছিলেন নারীদের উত্তরণ। তার জীবদ্দশাতে নারী মুক্তির আন্দোলনের স্বরূপ হিসেবে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষক গ্রহণের দিকটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। সমাজে এক নব সমাজ – সংস্কারক এবং নারীদের সর্বক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের পথিকৃৎ ছিলেন এই দয়ার সাগর।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বলা যায় যে, দয়ার সাগরের অবদান সমাজে নারীজাতির উপর সত্যিই অসামান্য। নারীদের যে নিজেদেরকে নিয়ে উন্নত চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন , উন্নত হওয়ার প্রয়োজন সমাজের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য, সেই জ্ঞান ,সেই চেতনা তিনিই প্রথম যুগিয়েছিলেন এবং বলা যায় একই সাথে দেখিয়েছিলেন নারীদেরকে সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথটিও ।
(tista4tista@gmail.com)