শান্তা অধ্যায়ের অবসান – শতাধিক বর্ষ পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে আরেক আশুতোষ : পারবেন কি ‘বাংলার বাঘ’ এর যোগ্য উত্তরসুরি হতে ?

কলকাতা, ৭ অক্টোবর : রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে জটিলতা কাটাতে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের নেতৃত্বে সার্চ কমিটি তৈরি করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদপ্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করে শীর্ষ আদালতে সুপারিশ জমা দিয়েছিল এই কমিটি।অবশেষে সুপ্রিম কোটের হস্তক্ষেপে কাটল দীর্ঘদিনের জটিল জট। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ মোট আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের সম্মতি দিল সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশুতোষ ঘোষ এবং যাদবপুরে চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে মনোনীত হলেন। এছাড়া,ওমপ্রকাশ মিশ্রকে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু তালেব, সাধু রামচাঁদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দ্রদীপা ঘোষ, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আশিস ভট্টাচার্য, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে উদয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ণব সেনকে স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর।

স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের আগে  ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে ছিলেন শান্তা দত্ত দে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষানীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে শান্তার দৃঢ় অবস্থান  নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয় । কখনও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সহ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাদের সঙ্গে মতবিরোধ ও সংঘাতের ফলে  তিনি প্রায়ই খবরের শিরোনামে ছিলেন ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষানীতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে শান্তার দৃঢ় অবস্থান অনেকেরই অস্বস্তির কারণ  হয়েছিল। তাঁর নেওয়া কিছু কড়া সিদ্ধান্তে রাজ্য সরকার এবং শাসক দলকে যথেষ্ট  বিব্রত করেছিল।এমনকি, মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধও তিনি বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যা শিক্ষাক্ষেত্র তো বটেই, রাজনৈতিক মহলেও বিরল বৈকি !

 রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে দ্বন্দে শান্তা কখনও শান্ত থাকেন নি ,  দমে যান নি।  শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু তাঁকে প্রকাশ্যে নানা মন্তব্যে আক্রমণ করেন। শান্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পর্যন্ত প্রশ্ন তোলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের এক নেতা।তবুও নয় !  চোয়াল শক্ত রেখে তিনি নিজের অবস্থানে অতল থাকেন। এক কথায়  স্বল্প মেয়াদের  হলেও শান্তা দত্তের অধ্যায় ছিল দৃঢ়তার ও  আত্মসম্মানের এক  আপসহীন বিরল অধ্যায় ।

পূর্ববর্তী ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্তের সঙ্গে রাজ্য সরকারের তুমুল  সংঘাতের  পর স্বাভাবিকভাবেই নতুন উপাচার্যকে নিয়ে বিস্তর কৌতূহল তৈরি হয়েছে নেটিজেনদের মধ্যে ।

অধ্যাপক আশুতোষ ঘোষের জন্ম ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পাশ করেন। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে M.Sc করেন। Ph.D করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।  বিশ্বের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের পর ১৯৯০ সালে লেকচারার হিসেবে ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন আশুতোষ।  এরপর ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সিনিয়র লেকচারার হিসেবে বিধাননগর গভর্নমেন্ট কলেজে ছিলেন। ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। তারপর ধাপে ধাপে রিডার, প্রফেসর এবং রসায়ন বিভাগের প্রধান হন। ২০১৩ সালের অগস্ট থেকে ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল ফর পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন সায়েন্সের ডিন ছিলেন তিনি।আশুতোষ আমেরিকার ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে অল্প কিছুদিনের জন্য জার্মানির দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি ।

প্রসঙ্গত , আশুতোষ এই প্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পাচ্ছেন না। পূর্বেও  অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে  ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত  দায়িত্ব সামলেছেন। এবার স্থায়ী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেলেন তিনি ।

ইতিহাস কত অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী !  প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি দিন  আগের কথা। ‘বাংলার বাঘ’  স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ এবং ১৯২১ থেকে ১৯২৩, দুই দফায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন । কলকাতা যেন শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে এটাই ছিল স্যর আশুতোষের লক্ষ্য। শতাব্দী পেরিয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী উপাচার্য হচ্ছেন আর এক আশুতোষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশ তথা বিশ্বে শিক্ষা ও গবেষণার মানচিত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি কতখানি সফল হন সেটাই এখন দেখার।সময় বলবে বৈকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *