তিস্তা মন্ডলের প্রতিবেদন
“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি” — এই গানটি শুনলে আজও দেশাত্মবোধের সবটুকু আবেগ , অনুভূতি জেগে ওঠে সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয়ে। গানটি কানে আসা মাত্রই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আবেগপ্রবণ হৃদয়ে যে নামটি বারবার উঠে আসে তিনি হলেন ক্ষুদিরাম বোস ,চরম অত্যাচারী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে প্রথম ও সর্বকনিষ্ঠ শহীদ। কিন্তু সব বিদায় কি বিদায় হয় ? না, কোন কোন বিদায় চিরচিহ্ন রেখে যায় আমাদের সকলের মনে। ঠিক তেমনি একটি অবস্মরণীয় অধ্যায় হল , ক্ষুদিরাম বোস।

১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মেদিনীপুরের হবিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।আগের দুই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মারা যাওয়ায় তৃতীয় সন্তানের প্রাণ রক্ষার জন্য সংস্কার বশতঃ মাসীর কাছে ৩ মুঠো খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাকে তার মা, সেই থেকেই তার নাম ক্ষুদিরাম ,,হ্যা ,, ত্রৈলোক্যনাথ বোস ও লক্ষিপ্রিয়া দেবীর চতুর্থ সন্তান ক্ষুদিরাম বোস। পাঁচ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম মাকে হারান এবং পরবর্তী বছরে বাবাকে হারান। প্রাথমিক জীবনে ক্ষুদিরাম তমলুকের হ্যামিল্টন স্কুল এবং মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষালাভ করেন।ছাত্রাবাস্থা থেকেই ক্ষুদিরাম পরাধীন দেশমাতার মুক্তির জন্য লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন ।নবম শ্রেণীতেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পুরোপুরি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ ক্ষুদিরামের।তখন তাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। লাঠি চালানো থেকে শুরু করে বন্দুক চালানো সবই ছিল নখদর্পণে। শিখেছিলেন বোমা বাধাও।
১৯০৬ সালে, মেদিনীপুরে একটি শিল্পমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মেলায় সােনার বাংলা নামে বিপ্লবী পুস্তিকা প্রকাশ করতে গিয়ে ক্ষুদিরাম প্রথম রাজনৈতিকভাবে অভিযুক্ত হন। পুলিশের বাধা পেয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন। পুলিশ ক্ষুদিরামের উপর অত্যাচার শুরু করতে বাধ্য হল, কিন্তু তিনি কোনও তথ্য প্রকাশ করেননি। সরকার ক্ষুদিরামকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।এরপর ১৯০৭ এ নারায়ণগড় রেলস্টেশন বোমা বিস্ফোরণ ঘটান ক্ষুদিরাম ।মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড ছিলেন তখন।সে সময় অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংফফোর্ট নির্মম শারীরিক নির্যাতনের সাজা দিচ্ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের । এই নির্মমতার বিরুদ্ধে তাকে হত্যার ছক কষা হলো। ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী নিলেন এই গুরু দায়িত্ব ।
১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল পরিকল্পনামাফিক বিহারের মুজাফফরপুর ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে ভুলবশত কিংসফোর্ড ঘনিষ্ঠ ব্রিটিশ ব্যারিস্টার প্রিঙ্গল কেনেডির মেয়ে ও স্ত্রীর গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান তারা। প্রথমে তার মেয়ে , এবং কিছু সময় পরে তার স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে।অভিযুক্ত ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয় ২১শে মে ১৯০৮ তারিখে যা আলিপুর বোমা মামলা নামে পরিচিত হয়। এই মামলাতেই ক্ষুদিরামের ফাঁসির সাজা হয়। অপরদিকে সঙ্গী প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন।
ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয় মুজাফফরপুর জেলে , যেটির নাম পরবর্তীকালে পরিবর্তন করে রাখা হয় ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল জেল। ফাঁসির জন্য জেলের মধ্যে ১৫ ফুট উঁচু মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ার আগে হাসতে হাসতে ক্ষুদিরাম জল্লাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ফাঁসির দড়িতে মোম লাগানো হয় কেন ? এটিই ছিল তার শেষ কথা। এই কথাটি শুনে সেখানে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল বাচ্চা ছেলেটির মৃত্যুবরণের চরম মুহূর্তেও এরূপ শান্ত নির্বিকার ভাব দেখে।
দেশের স্বাধীনতা লাভের জাগ্রত স্বপ্নকে অধরা রেখেই বীর বিক্রমে আত্মাহুতি দিয়ে ক্ষুদিরাম সেদিন ভারতের স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করে , জাগ্রত করে দিয়ে গিয়েছিলেন বৈকি !