স্তব্ধ আজ তবলা ঝংকার : স্মরণে উস্তাদ জাকির হুসেন

যুগবীক্ষণ ডিজিটাল ডেস্ক (Whatsap-7604097600 / 7365021506 )

কলকাতা,১৮ ডিসেম্বর : আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপী প্রবাহিত তাঁর অপূর্ব তবলা লহরীকে স্তব্ধ করে চিরবিদায় নিলেন উস্তাদ জাকির হুসেন। ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছর বয়সে সান ফ্রান্সিসকোর  হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই বিশ্ববিখ্যাত কিংবদন্তি তবলাবাদক ।  রেখে গেলেন স্ত্রী , মেয়ে দুই ভাই  এবং এক বোন  এবং  দেশ ও বিদেশের অগুণতি গুণমুগদ্ধ শ্রোতা ও ভক্তদের ।জাকির হোসেনকে চেনেন না সমগ্র  বিশ্ব জুড়ে  এমন মানুষের সংখ্যা সত্যি কম  কম। বিশ্ব ধ্রুপদী সঙ্গীতবাদ্যের জগতে তিনি এক অতি উজ্জ্বল নক্ষত্র । স্বাভাবিকভাবেই   শিল্পীর হঠাৎ প্রয়ানে  শোকের  ছায়া  সব  মহলেই।

    প্রখ্যাত তবলা বাদক উস্তাদ আল্লা রাখার জ্যেষ্ঠ পুত্র জাকির হুসেন ১৯৫১ সালের ৯ মার্চ মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তবলা বাজানোর প্রতি হুসেনের এই ঝোঁক খুবই অল্প পরিসর থেকেই ,  মাত্র ৩ বছর বয়সে বাবার কাছে থেকে মৃদং বাজানো শিখেছিলেন তিনি। ১২ বছর বয়স থেকে সংগীত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন তিনি । সংগীতের প্রতি বিশেষ আগ্রহ এবং কঠোর প্রশিক্ষণই হুসেইন কে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তবলা বাদক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত কে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছিলেন তিনি  । শুধুমাত্র একজন সংগীত শিল্পীই  নন ,  সুসংস্কৃতির  বার্তাবাহক  রূপেও খ্যাতি অর্জন করেছেন হুসেন। সুর , তাল এবং বাদনের অসামান্য সৃষ্টিশীলতা এবং দক্ষতা তাকে বিশ্বজুড়ে সম্মানীয় এবং শ্রদ্ধেয় করে তুলেছে।

==================================================

অজানার আলোকে উস্তাদ জাকির হুসেন  : এক নজর
● হুসেন নয় জাকিরের আসল পদবী ছিল ‘কুরেশি’, তাঁর উপাধি ছিল ‘হুসেন’ ।
● জাকিরের মায়ের নাম ববি বেগম
● তার দুই মেয়ে আনিসা কুরেশি ও ইসাবেলা কুরেশি
● জাকিরের দুই ভাই তৌফিক এবং ফজল কুরেশি এবং বোন খুরশিদ আউলিয়া
● জাকিরের কেরিয়ার শুরু তবলা বাদক হিসেবে নয় , চলচ্ছিত্রের মাধ্যমে। ১ ৯৮৯ সালে ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’ চলচ্চিত্রে প্রথম আত্মপ্রকাশ তাঁর । সেখান থেকেই কেরিয়ার যাত্রা শুরু। শুধু ছবিতে অভিনয়ই নয় ,ছবির জন্য সঙ্গীতও করেছিলেন।
● তিনিই প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞ যাকে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন অল-স্টার গ্লোবাল কনসার্টে যোগ দেওয়ার জন্য।
● জাকির হুসেনের স্ত্রী আন্তোনিয়া মিনেকোলা একজন ইতালিয়ান আমেরিকান। তিনি পেশায় ছিলেন কথ্থক নৃত্যশিল্পী।==================================================

 প্রথম থেকেই সংগীতের প্রতি অসীম ভালোবাসা, সৃষ্টিশীলতা এবং সূক্ষ্মতা আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল সঙ্গীত, জ্যাজ এবং বিশ্ব সঙ্গীতের ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদী সঙ্গীত জীবনে তিনি বহু বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন , এর মধ্যে রয়েছেন, রবি শঙ্কর , জর্জ হ্যারিসন , জন মাকলফলিন এর মতন  শিল্পীরা। ১৯৭৩ সালে জাকির , মাকলফলিন, তালবাদ্য শিল্পী টি এইচ ‘ভিকু’ বিনয়ক্রম , বেহালা শিল্পী এল শঙ্কর সম্মিলিতভাবে গড়ে তোলেন সঙ্গীতের এক নতুন দিশারী  ‘শক্তি’ নামক একটি ব্যান্ড , সেই সময় থেকে শুরু করে আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে এটি। এই ব্যান্ডটি ‘গ্র্যামি’  পুরস্কার লাভ করে। 

 ‘গ্ৰ্যামি’  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংগীত শিল্পের অসামান্য কৃতিত্বের জন্য প্রদান করা হয়।  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, জাকির হুসেন এর  ঝুলিতে মোট চারটি ‘গ্ৰ্যামি’  রয়েছে ,  তার মধ্যে তিনটি  এই বছরেই লাভ করেছিলেন তিনি। শিক্ষক হিসেবে নতুন প্রজন্মের সংগীত শিল্পীদের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত ছিলেন তিনি। তাঁর শিক্ষণ কৌশল গুলি ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত ,  নির্ভুল এবং গভীর। আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব সহ বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের একত্রিত করেছেন তিনি , যা সংগীতের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পারস্পরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের লক্ষ্যেও  কাজ করেছে।

জাকির হুসেন সঙ্গীতের জগতে তাঁর অসাধারণ অবদান রেখে গিয়েছেন, যার জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর  অসাধারণ প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ  পদ্মশ্রী থেকে শুরু করে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মভূষণ , পদ্মবিভূষণ, গ্র্যামি,সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।চলতি বছর গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছিলেন জাকির হুসেন। বেস্ট গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম হিসেবে ‘শক্তি’ ব্যান্ডের গানের অ্যালবাম ‘দিস মোমেন্ট’ পুরস্কার পায়। ব্যান্ডের কণ্ঠশিল্পী শঙ্কর মহাদেবন এবং তবলাবাদক ছিলেন তিনি।এই  জুটির হাত ধরেই ২০২৪ সালে ভারতে  আসে গ্র্যামি ।

জাকির হুসেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন ।তবলাকে কেন্দ্র করে  বিশ্বমঞ্চে অতুলনীয় ছন্দে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিমোহিত করেছেন। তিনি তাঁর অসাধারণ সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্য পরিচিত ছিলেন । কয়েক প্রজন্মের সঙ্গীতপ্রেমীদের তিনি তাঁর অপূর্ব তবলা লহরীতে মুগ্ধ করেছেন । প্রায় ছয়  দশকের কর্মজীবনে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও আন্তর্জাতিক সঙ্গীত জগতে বড় অবদান রয়েছে জাকির হুসেনের ৷ এই তবলা জাদুকরের চলে যাওয়া ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি বৈকি৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *