ড. নির্মল দে
কলকাতা, ২১ জুলাই : সালটা ১৯৯৩।রাজ্যে মধ্য গগনে বামশাসন। তখনও রাজ্য রাজনীতির ময়দানে আজকের শাসক দল তৃণমূলের জন্মই হয়নি। তখন পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের ‘আগুনে নেত্রী’ তথা সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দোর্দণ্ডপ্রতাপ জ্যোতি বসু । সিপিএমের বিরুদ্ধে ছাপ্পা-রিগিং-এর অভিযোগ নিয়মিত শোনা যাচ্ছে বিরোধিদের মুখে। এমন আবহেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার জন্য সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দাবিতে ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন তৎকালীন যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে এই কর্মসূচি দিন ঠিক হয়ে ছিল ১৪ জুলাই। কিন্তু সে বছর ওই সময় প্রাক্তন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের প্রয়াণের জন্য কর্মসূচি পিছিয়ে ২১ জুলাই করা হয়।

২১ জুলাই মমতার ডাকে মহাকরণ অভিযানের জন্য কলকাতার রাজপথে নামেন কয়েক হাজার যুবকংগ্রেসকর্মী।এই অভিযান রুখতে অতি তৎপর হয় পুলিশ। বিভিন্ন ক্রসিং-এ গড়া হয় ব্যারিকেড। এরপরই হঠাৎ চলতে থাকে গুলি। সেই গুলিতে নিহত হন ১৩ জন যুবকংগ্রেস কর্মী। আহত হন মমতা বন্দোপাধ্যায় স্বয়ং।নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেদিনের অমানবিক পুলিসি হত্যালীলার বলি যারা হয়েছিলেন সেই ‘শহিদ’রা হলেন- বন্দনা দাস, মুরারী চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, শ্রীকান্ত শর্মা, দিলীপ দাস, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ দাস, মহম্মদ খালেক এবং ইনু মিয়াঁ ।

এই ১৩ যুবকংগ্রেসকর্মীর মৃত্যুতে রীতিমতো উত্তাল হয়ে ওঠে রাজ্য রাজনীতি। কার নির্দেশে গুলি চালাল পুলিশ, এই প্রশ্নের আজও মীমাংসা হয়নি। উল্লেখ্য, সেসময় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে পরবর্তীকালে এ ঘটনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ক্নিনচিট দেয় সিবিআই।
প্রশ্ন হল ১৯৯৩ সালের সেই বর্বরোচিত ঘটনার পর কী পরিবর্তন আসে বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে ? বলা বাহুল্য সেই বছর ২১শে জুলাইয়ের ঘটনার পর রাজ্যের রাজনীতিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল যার ফল ছিল সুদূরপ্রসারী ।এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক কী সেই পরিবর্তন —
১. এই ঘটনার পর মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একজন আগুনে নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গঠনে সফল হতে শুরু করলেন ।
২. ১৯৯৩ সালের ঘটনার পরই কার্যত বামফ্রন্ট সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা কমতে থাকে। এর ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে বামফ্রন্টের ভোট কমতে থাকে।
৩.কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম হল আজকের রাজ্য শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের। ১৯৯৮ সালে মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেস ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন ।
৪.বলা বাহুল্য, ২১ এর ঘটনার পর থেকে রাজ্যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ বেড়ে যায়।
৫. নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন: ভোটার পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার দাবি জোরদার হয় এবং পরবর্তীতে এটি কার্যকরও করা হয়।
৬.এই ঘটনার পর যুব রাজনীতির উত্থান হতে থাকে। রাজনৈতিক ময়দানে তাদের গুরুত্ব বাড়ে। যুবরা রাজনীতিতে বেশি করে যুক্ত হতে থাকে। যুব নেতৃত্বের প্রতি দলের আস্থা বাড়তে থাকে ।
৭. ২১ এর পরথেকে সরকার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলি গতি পায় , জোরদার হয়। বিরোধী দলগুলো একত্রিত হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হয় ।
এই ভাবেই ১৯৯৩ সালের ২১ শে জুলাইয়ের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং পরবর্তী দশক গুলোতে রাজ্যের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বৈকি ।